রফিকুর রশীদ ||
আমি একা নই, সকালের এই ট্রেন ধরে অনেকেই এ লাইনে ডেইলি-প্যাসেঞ্জারি করে। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন চলে যায় রাজশাহী অভিমুখে। মাঝখানে পোড়াদহ জংশনে এসে কুষ্টিয়াগামী এক গাদা প্যাসেঞ্জার ঢেলে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে সেই ট্রেন ছুটে চলে উত্তরে। পোড়াদহ থেকে কুষ্টিয়া খুব দূরে নয়, কিন্তু অফিসমুখো এই মানুষগুলো সেই পথটুকু পাড়ি দেয় কী উপায়ে?
গোয়ালন্দগামী কোনো কানেক্টিং ট্রেন তো আর দাঁড়িয়ে থাকে না! স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে নানান কিছিমের যানবাহন-স্কুটার, অটোরিকশা, এমন কি নসিমন-করিমন পর্যন্ত। কে কার আগে ছেড়ে যাবে এবং কত দ্রুত কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছে দেবে তাই নিয়ে বিরামহীন হাঁকডাক আর টানাটানি চলে ট্রেন ছেড়ে যাবার এই সময়টাতে। ওদের এই অসুস্থ ধাক্কাধাক্কিতে দুর্ঘটনা লেগেই থাকে নিত্যদিন, প্যাসেঞ্জার তবু আগে যাবার বাহনটাই ধরতে চায়। ডিসি অফিসের চাকরি আমার, আলমডাঙ্গা থেকে এই ট্রেন ধরে প্রতিদিন যাই কুষ্টিয়া, আমারও তাড়াহুড়ো থাকে যথেষ্ট, দু’পাঁচ মিনিটের আগেপিছে হলেই নাকে-মুখে টানটান দশা হয়। সামান্য কেরানি আমি, তখন আর বড় কর্তার চোখের দিকে তাকানো যায় না। কাজেই আমাকেও আগে যাবার বাহন খুঁজে বের করতে হয়।
কিন্তু সেদিন আমার কী যে হয় ভেতরে ভেতরে, বড়কর্তার চোখ রাঙানির কথা একটুও মনে পড়ে না, আমার টেবিলে আটকে থাকা জরুরি ফাইলও যেন-বা তুচ্ছ হয়ে যায়, আমি বিমুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি রসকলির মুখের দিকে। আমি জানি রসকলি তার নাম নয়, কী যে তার প্রকৃত নাম সেটাও ঠিক মনে পড়ছে না, কপাল জোড়া সাদা রঙের রসকলি এঁকে মেয়েটি তার পূর্বপরিচয় আড়াল করতে চেয়েছে কিনা তাও আমার জানা নেই, কিন্তু সেই চুনমাখা রসকলির রেখা মেয়েটির চেহারায় কী যে এক অনিন্দ্য দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছে সে বিবরণ দেবার সাধ্য আমার নেই। কূল উপচানো নদীর মতো শরীরজোড়া তার যৌবন জলতরঙ্গের কানাকানি দশা যেন গেরুয়া বসনে আরো বেশি মাত্রায় ফুটে উঠেছে, দুহাতের বাজুতে বাঁধা শুচিহার এবং গলায় পেঁচানো রুদ্রাক্ষের মালা কী যে ব্যাখ্যাতীত শাসনবারণের ঘোষণা জারি করতে চাইছে, কিন্তু প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ যার সে কেন নিষেধের তর্জনির কাছে বশ্যতা মানবে!
সে একা নয়, বেশ কজন নারী-পুরুষের একটা বাউলদল আছে তাকে ঘিরে, এ রকম ছোটখাটো একাধিক দল কাঁধে ফকিরি ঝোলা এবং হাতে একতারা বা দোতারা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ছেঁউড়িয়ার উদ্দেশে, ট্রেনে ওঠার পর সেটা ভালোই টের পাই। প্রায় সব বগিতে দু’চারজন বাউলের উপস্থিতি জানিয়ে দেয় এই পূর্ণিমায় লালন-মাজারে দুদিনের সাধুসঙ্গের কথা, পোড়াদহে নামার পর তাদের সংখ্যা দেখে বিস্ময়ের অবধি থাকে না- এ তলাটের এতগুলো মানুষ তাহলে গূঢ় এই সাধন-ভজনের চর্চা করে! আমার খুব ভাবনা হয়- এরা সবাই গৃহী, নাকি সন্ন্যাসী!
আমিই-বা কতটুকু জানি এদের, কতটুকু চিনি?
শামুকের খোলসের মতো শক্ত আবরণ এদের, বাইরে থেকে সে আবরণ চোখেই পড়ে না, দেখে মনে হবে সহজ সরল সাদা-সিধে মানুষ, বিদ্যের বহর বড়জোর অক্ষর পরিচয় পর্যন্ত; অথচ তত্ত্বজ্ঞানের বেলায় সবাই সাংঘাতিক টনটনে। প্রচলিত শব্দার্থতত্ত্বের ধার ধারে না তারা, শব্দই তাদের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র, তাই দেখেশুনে আদ্যোপান্ত জেনেবুঝে সে অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটাতে চায়। শব্দকে বলে ধারালো অস্ত্র, সারা গায়ে ধার; খুব সাবধানে ধরতে হয়, সতর্ক ভঙ্গিমায় প্রয়োগ ঘটাতে পারলে তখন শব্দেরা হেসে ওঠে খলবলিয়ে, ঝলসে ওঠে দ্যুতি। কিছু না বুঝেই আমি একদা লালনের গানের প্রেমে পড়েছিলাম, বেশ পাগলামিও করেছি সে সময়ে; গানের টানে খুঁজতে খুঁজতে আনন্দধামে গিয়ে মজনু ফকিরকে আবিষ্কার করেছি। আত্মীয়তার একটা সুতো পড়েছিল অবহেলায়। আমার মেজ মামার সম্বন্ধি মজনু ফকির পরিচয়-টরিচয় জানার পর কেমন অবলীলায় ঘোষণা করে- সুতো ছিঁড়ে গেছে অনেক আগে, তবু সত্যি করে বলো তো- কী চাও তুমি?
কী যে চাই, কেন এত পথ উজানে এসেছি, সে কথা গুছিয়ে বলা হয় না আমার। তরে সাঁইজির মরমী পদের প্রতি আমার প্রবল টান থেকেই যে এতদূর ছুটে আসা, সে কথা অকপটে খুলে বলতেই গোঁফদাড়ির আড়াল থেকে তিনি স্মিত হাসি ছড়িয়ে জানান- এ পথ আরো বহু দূরের বাপু, দুস্তর দুর্গম। অনেক ভেদ আছে।
গল্প শুনেছি মজনু মামা বাউল হয়ে যাবার পর ঘরও ছেড়েছেন, ঘরের বাঁধনও ছিঁড়েছেন। সংসারের মোহজাল কেটে বেরিয়ে আসাটা খুব জরুরি বিবেচিত হওয়ায় তিনি স্ত্রী এবং এক শিশুকন্যা ত্যাগ করে এসে আনন্দধামে আত্মনিয়োগ করেছেন বহু বছর আগে। আমার কণ্ঠে মামা-সম্মোধনে তিনি চমকে ওঠেন, সহাস্যে গেয়ে ওঠেন- ‘সবই মিছে আর ফাঁকিরে বাবা, মিথ্যেভ্রমে চলছে দুনিয়া।’ জোর দিয়ে বলেন, মানুষ রতন খুঁজতে হবে জনমভর।
বেশ কিছুক্ষণ পর আমি টের পাই রসকলিদের বিশেষ কোনো তাড়া নেই। ট্রেন চলে যাবার পর তারা থোকায় থোকায় গোল হয়ে বসে আছে প্লাটফর্মের এখানে সেখানে। যেন-বা আলস্যে রোদ পোহাচ্ছে। নাগাদ সন্ধ্যে ছেঁউড়িয়ায় গিয়ে সাঁইজির ধামে পৌঁছুলেই হবে। সেই ভাবনা থেকেই তারা গা-আলগা দিয়ে বসেছে। এরই মাঝে কারো হাতের একতারা বেজে ওঠে টুংটাং, কেউবা কাঁধের ঝোলা থেকে কল্কে বের করে সেবার আয়োজন করে। কল্কের ভেতরে তামাক অথবা গঞ্জিকা যা-ই থাক, তাদের সাংকেতিক ভাষায় সেবনের এই প্রক্রিয়াকে বলে ‘সেবা’। সেবার এই আয়োজন দেখে পার্শ্ববর্তী এক গ্রুপ থেকে মধ্যবয়সী এক বাবাজি ‘জয়গুরু’ বলে কপালে দুহাত ঠেকিয়ে এগিয়ে আসে এবং সে দিব্যি রসকলির পাশে থপ্ করে বসে পড়ে। কী অসুবিধা হয় রসকলির সে কথা আমি জানি না, ঠিক তক্ষুনি তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে আমি সহসা চম্কে উঠি। সেই মুহূর্তে তার চোখে চোখ পড়তেই আমার হৃৎপিণ্ড দুলে ওঠে, ভেতরে ভেতরে ভয়ানক শিহরিত হই, নিজেকেই প্রশ্ন করি- আমি কি আদৌ চিনি এই মেয়েটিকে? আবার উল্টো করেও ভাবি- সে কি চিনতে পেরেছে আমাকে? এই চেনা অথবা অচেনায় কিছুই যায় আসে না জগৎসংসারে সে আমি জানি, তবু তাকে ছেড়ে যেতে আমার পা ওঠে না কিছুতেই, দৃষ্টি সরাতে গিয়েও পারি না।
কিন্তু এ সবের মানে কী?
যারা সাধুসঙ্গে যাবার উদ্দেশ্যে পথে নেমেছে, তাদের সঙ্গে আজ আমার কীইবা সম্পর্ক! আমার পথ তো ভিন্ন! আমার ঘরসংসার আছে। আমার সরকারি চাকরি আছে। পদে পদে ভ্রুকূটি আর কৈফিয়তের জবাব দেবার দায় আছে। আমি কেন প্লাটফর্মে এভাবে দাঁড়িয়ে আছি? আমার ডেইলি-প্যাসেঞ্জারি সহযাত্রীদের কেউ তো এ রকম আটকে পড়েনি! যে যেভাবে পেরেছে, আপন গন্তব্যে ঠিকই রওনা হয়ে গেছে। এতক্ষণে প্লাটফর্মের নিচের স্ট্যান্ড থেকে দুতিনজন ড্রাইভার উঠে আসে উপরে। অটো কিংবা টেম্পো চালায় তারা। নসিমনও হতে পারে। না, যতই আমি ডেইলি-প্যাসেঞ্জার হই, আমার দিকে মোটেই ভ্রুক্ষেপ নেই তাদের। তারা এসেছে সাধু-সন্ন্যাসী ভজাতে। কুষ্টিয়া হতে সোজা ছেঁউড়িয়া পর্যন্ত এক ট্রিপ প্যাসেঞ্জার ধরতে পারলে বেশ হয়। সেই প্রস্তাবই মুখে উচ্চারণ করে খোলামেলা- চলো গো বাবাজি, ছেঁউড়ি যাবা তো আমার গাড়িতি চলো।
খুব একটা গা করে না সাধু-সন্ন্যাসীর দল। তারা নিজের জগতে মশগুল। সত্যিই যেন তাড়া নেই। কমবয়সী এক বাউল জানতে চায়, তোমার গাড়ি মানে কী গাড়ি- টেম্পো, না নসিমন?
ওরে বাবা, তুমাগের জন্যি পঙ্খিরাজ রেডি কইরি রাইখিছি, চলো দিনি। চলো।
না, এত সহজে ফাঁদে পা বাড়াতে রাজি নয় সে। বাইরে সন্ন্যাস-ভেক ধরলেও বাস্তব-বুদ্ধি তার হারায়নি মোটেই। তাই সে একটুখানি খেলিয়ে দেখতে চায়- পঙ্খিরাজে কজন ধরবে, ভাড়া কত নিবা, সেসব খোলাসা করবা তো!
তা বটে। প্যাসেঞ্জার এ কথা বলতেই পারে। ড্রাইভার লোকটা ঢোক গিলে হজম করে এই প্রসঙ্গটি। এই ফাঁকে অন্য এক ড্রাইভার এসে নতুন করে ভজাতে শুরু করে। এভাবে চলতে থাকে দামদস্তর। দুএকটা গ্রুপ উঠেও পড়ে টেম্পোতে কিংবা নসিমনে। লালন-প্রাঙ্গণ দিনে দিনে অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে, পশ্চিমে রাজঘাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পরিসর, তবু এই উৎসবের দিনে স্থান সংকুলান হতে চায় না, তখন মোল্লাতে ঘরিয়া পর্যন্ত নানান বাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আশ্রয় নিতে হয়; সেখানেই গানবাজনার আসর বসে, নানান রকম সেবা-শান্তিও হয়। সারা দেশ থেকে এই মৌসুমে আউল-বাউল তো কম আসে না! ফলে আপন আপন ঠাঁই ঠিকানার কথা একটু আগেভাগে তো ভাবতেই হয়। কিন্তু রসকলির গ্রুপের কারো চোখেমুখে উদ্বেগের কোনো ছাপ আছে বলে মনে হয় না। ভেটুলতলার আলো-আঁধারি ছায়ায় জমিয়ে বসেছে তো বসেই আছে। বাবরি চুলের এক বাউল দিব্যি একতারা বাজিয়ে গান ধরেছে- ‘জাত গেল জাত গেল বলে এ কী আজব কারখানা…।’
লালনের এই বিখ্যাত জাতবিচারি গান আমাদের এ তলাটে পথেঘাটে হরহামেশাই শোনা যায়, বিশেষ করে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠের রেকর্ড তো পানবিড়ির দোকান থেকে ভদ্রলোকের বৈঠকখানা পর্যন্ত বেশুমার বেজেই চলেছে, তবু এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ে যায় মজনু মামা মানে মজনু ফকিরের কথা। এই একটি গান ছিল তার সর্বক্ষণের ধ্যানজ্ঞান। ‘সুন্নৎ দিলে হয় মুসলমান, নারী লোকের কী হয় বিধান’-নিগূঢ় এই সমস্যার ঘোরে যেনবা হাবুডুবু খায় তার কণ্ঠ। এই গানটির প্রতি তার এমন পক্ষপাতের নেপথ্যে মজার কেচ্ছা শোনা যায় গ্রামের লোকজনের কাছে। সবাই জানে সে কেচ্ছা, তবু গ্রাম-সুবাদে নানি সম্পর্কের বৃদ্ধা রমেছা বেওয়া সর্বজনবিদিত সেই কাহিনি আমাকে শোনানোর সময় কানের কাছে মুখ নামিয়ে খাটো গলায় বলে, পালবাড়ির ইন্দুবালার সঙ্গে মজনু ফকিরের লটরপটরের কতা কিডা না জানে! রমেছা নানি নিজেই আবার সংশোধন করে নেয়- না না, মজনু তখুনু ফকির হয়নি। সে তো ফকির হ’লু ইন্দুবালা গলায় দড়ি দিয়ার পর। মুখি মুখি কত কু-কতা যে গায় মান্ষি-ইন্দুর বোলে ছ’মাসের গর্ভ ছেল!
শুনে আমার কান গরম হয়ে যায়। মজনু মামার স্ত্রী এবং তার ফুটফুটে কন্যা সুলতার চেহারা মনে পড়ে যায়। এদের সঙ্গে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ আমার হয়নি তবু ভালো লেগেছে মা-মেয়ে দুজনকেই। সেই দুজনকে কষ্ট দিয়ে মজনু মামার এ সব রঙ্গলীলার কেচ্ছা শুনে সেদিন আমার মনটা ভয়ানক বিষিয়ে ওঠে। আমি ভাবতেই পারি না এমন পঙ্কিল পথ বেয়ে কেউ সাধু সন্ন্যাসী হতে পারে! ভেতরে ভেতরে আমার ঘোর কাটতে শুরু করে, মনে হয়-সবই মিছে আর ফাঁকি!
এ সব সেই কবেকার কথা! এতদিন পর ছোট্ট সেই সুলতাকে আমি যেন খুঁজে পাই এই রসকলির মুখের আদলে। সবশেষ সুলতাকে আমি যখন দেখি, তখন তার দুরন্ত কৈশোর। হঠাৎ একদিন খবর পাওয়া গেল মজনু ফকিরকে কে বা কারা রাতের আঁধারে খুন করে তার আখড়াবাড়ির দক্ষিণে বকুলগাছে লাশ ঝুলিয়ে রেখে গেছে। এলাকায় সাংঘাতিক তোলপাড় সৃষ্টি হয় এ খবরে। সবাই বিস্ময়ে আহা আহা করে- এটা কী হলো! খুন জখম প্রতিদিন হচ্ছে, তাই বলে একটা ঘরছাড়া বাউলের এই দশা! তার উপরে আমি শ্রদ্ধা হারিয়েছি অনেক আগেই, তবু এমন একটা পরিণতির কথা কখনো ভাবতেই পারিনি। ভেতরের দ্বিধা কাটিয়ে আরো অনেকের মতো আমিও ছুটে যাই আনন্দধামে। কিন্তু ওই গ্রামে পৌঁছুনোর পর আমার মন বদলে যায়। আখড়াবাড়ি যেতে আর ইচ্ছে করে না; আমি সোজাসুজি গিয়ে সুলতাদের বাড়িতে উঠি। মামিকে দেখে চম্কে উঠি- এ যেন বাজপড়া ঠা ঠা তালগাছ। ঘর সংসার সেভাবে না থাকুক, তবু তো স্বামী বলে কথা, তার এমন আকস্মিক এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুতে হতবিহ্বল হয়ে পড়ারই কথা। কিন্তু আমার চোখে তারও বেশি কী যেন ধরা পড়ে, আমি কিছুই বলতে পারি না, শুধু পলকহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
সেই একদিন আমি সুলতাকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই। আমার সঙ্গে ছিল ইমরান, মেজ মামার ছেলে। আলমডাঙ্গা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বয়সে আমার চেয়ে বেশ খানিক ছোট, তবু সুযোগ পেলেই সে আমার গায়ে গায়ে লেগে থাকে। মাথা ভর্তি নানান পরিকল্পনা তার, ইন্টারমিডিয়েট পেরুলেই সে সব বাস্তবায়নে নেমে পড়বে। মেজ মামাকে সম্মত করানোর কাজে আমার সহযোগিতা লাগবে, সেই কথা ঘনঘন মনে করিয়ে দেয়। সেই ইমরান হঠাৎ আমাকে বলে, সুলতার কাণ্ড দেখেছ ভাই?
আমি বুঝতেই পারি না- কী এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে মেয়েটি। আমি অবাক হয়ে তাকাই। চোখে চোখ পড়তেই সুলতা দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ইমরান আবারও বলে, ওই ছুঁড়িকে দেখে কারো মনে হবে- আজ ওর বাপ মরেছে অপঘাতে?
ইমরানের মামানো বোন সুলতা। তাই বলে আজকের দিনে এভাবে কথা বলার মানে কী সে রহস্য আমি ধরতে পারি না। কিশোরী মেয়েটিকে কাছে ডেকে কথা বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সে সুযোগ হয় না। ইমরানের কথার খোঁচায় সে সামনে থেকে সরে যায় নীরবে। তখন সে ক্লাস সেভেন কিংবা এইটে পড়ে। কিন্তু শরীর এমনই বাড়ন্ত যে দেখে মনে হবে স্কুল-ফাইনালও পেরিয়ে গেছে। ইমরানের কাছ থেকে পরে জেনেছি শরীরের চেয়ে বড় সমস্যা তার মনে। অল্প বয়সেই মারফতি গানের নেশায় পেয়েছে। হয়তো উত্তরাধিকারসূত্রেই এই নেশায় পেয়ে থাকবে। মজনু ফকিরের তো খুশি হবার কথা। কিন্তু তা হয়নি। এই নিয়েই বাপ-বিটির মধ্যে চরম খিটিমিটি। বাপের চোখে মেয়ে সেয়ানা হতে চায় না, তার মতে- ওইটুকু মেয়ে দেহতত্ত্বের কী বুঝবে! মারফতি গানে তো দেহভান্ডই মূখ্য বিষয়- যা আছে বিশ্বব্রহ্মান্ডে সবই পাবে দেহভান্ডে। দেহনদীতে জোয়ার-ভাটা আসে প্রাকৃতিক নিয়মে, তাই চারচাঁদের চন্দ্রকলা তো গুরুর ধরেই শিখতে হয়। সাধন-ভজন অতো সহজ নয়। সুলতা নাছোড়বান্দা। গুরু-মুরশিদ বাপকেই মানতে চায়। কিন্তু বাপ সেটা মানলে তো! মেয়েকে এই পিচ্ছিল পথে নামতেই দেবে না। সুলতার সহজসরল দাবি- তাহলে তুমিও ওই পথ ছাড়ো, ঘরে ফিরে এসো।
এ বৃত্তান্ত শুনে আমি চম্কে উঠি, জানার কৌতূহল হয়- মামির ভূমিকা কী? ইমরান বড় মানুষের মতো ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলে, সেটাই তো রহস্যজনক। সত্যি বলতে কী- আমার পক্ষে আর এ সব রহস্যের ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে ঢোকা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বাপ-বিটির এই মতবিরোধ এবং মামির রহস্যপূর্ণ ভূমিকা মজনু মামার এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর নেপথ্যে কোনো প্রভাব ফেলেছে কিনা তাও আমার জানা হয়নি। ইমরান ঠিকই ঢাকায় দাঁড়াবার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, আমি সামান্য এই কেরানিগিরি আর সংসার সমরে তটস্থ হয়ে কাটাই আমার দিনরাত্রি; এর মধ্যে মজনু ফকিরের অধ্যায় দূর অতীতের অন্ধকার গহ্বরে কখন তলিয়ে গেছে সে-কথা মনেও পড়ে না। এতদিন পরে পোড়াদহ স্টেশনচত্বরে এই রসকলিকে দেখে প্রগাঢ় সেই অন্ধকার ধীরে ধীরে যেনবা ফিকে হয়ে আসে, চোখে পড়ে অরুণ আলোর উদ্ভাস। সেই আলোয় আমার দুচোখ ঝলসে ওঠে, চেতনাও প্রায় লুপ্ত হবার দশা। নইলে এখানে এই প্লাটফর্মে এখনো আমি দাঁড়িয়ে আছি কেন? কোথায় আমার সরকারি অফিসের কাজের চাপ, বড়কর্তার চোখ রাঙানি! কোথায় আমার ঘর সংসার স্ত্রী-পুত্রের প্রতি দায়বোধ! সব তুচ্ছ হয়ে গেল!
হঠাৎ আমার পায়ের পাতায় বিষপিঁপড়ার দংশন অনুভব করি। নাকি স্যান্ডেলের ফাঁক গলে আলকুচি বা বিচুতিপাতা ছুঁয়ে গেল! পায়ের তালু থেকে মাথার চাঁদি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে জ্বলুনি। কেন, এমন হলো কেন? রসকলি তার দলবলের সঙ্গে টেম্পোতে উঠে পড়ছে বলে কি তবে আমার পা টল্কে ওঠে? হ্যাঁ, এরই মাঝে এক টেম্পোঅলা ঠিকই এদের পটিয়ে ফেলে। ড্রাইভারের পেছনে টানা দুটো বেঞ্চ বসানো আছে সমান্তরালভাবে, পাঁচ দু’গুণে দশজন বসবে এই দুই সিটে, আর ড্রাইভারের পাশে একজন। ড্রাইভারের মাথায় বাবরি চুল দেখে আমার সংশয় জাগে, এই লোকটিও বাউল-তরিকার লোক নয় তো!
একে একে সবাই গিয়ে সিটে বসে পড়ে ঠাসাঠাসি করে। রসকলিও বসেছে একজনের গায়ে হেলান দিয়ে। তার ডানপাশে আছে সাদা থান পরিহিতা এক বৃদ্ধা, আর বামপাশে আছে তেল চক্চকে সুঠাম দেহের এক যুবক। রসকলি বিপজ্জনকভাবে হেলে আছে বামদিকে। পাঁচজনের সিট নয়, তবু পাঁচজনকে বসাবেই। প্যাসেঞ্জারের যত কষ্টই হোক, মাথা গুণে ভাড়া আদায় করবে টেম্পোঅলা। ভাগ্যিস ডানপাশের বৃদ্ধা ক্ষীণতনু পাটকাঠির মতো পাতলা, নইলে ভরাস্বাস্থ্যের রসকলির শরীর তো আঁটবার কথা নয়। হয়তো এই আঁটোসাঁটো ঠাসাঠাসির মধ্যেও বিশেষ কোনো আনন্দ আছে ওদের। আমি যে একটা মানুষ, টেম্পোর এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি, তা যেন কারো নজরেই পড়ে না। অথচ আমার খুব ইচ্ছে করে রসকলির মুখোমুখি গিয়ে অন্তত একবার জিগ্যেস করি- এই মেয়ে, তুমি আমাদের মজনু মামার মেয়ে সুলতা নও? চোখে চোখ রেখে শুধাতে ইচ্ছে করে, আমাকে তুমি মোটেই চিনতে পারছ না?
সত্যিই যদি চিনতে না পারে! অথবা এতগুলো মানুষের মধ্যে যদি সে চিনতে না চায় দ্বিধাকন্টকিত দৃষ্টিতে আমি তার দিকে তাকাই। অথচ তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আছে আপন ভুবনে মশগুল। এতক্ষণে হঠাৎ এক প্রশ্নের ঘাই ওঠে অন্তরে- আমিই কি নিশ্চিত যে রসকলি আঁকা এই মেয়েটিই সেদিনের সুলতা? কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে এমনও তো হতে পারে! আমি যখন এই বিপরীত ভাবনার পথ ধরে এগোচ্ছি, টেম্পো-ড্রাইভার ঠিক সেই সময়ে আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করে- আপনি যাবেন ভাই?
‘আমি!’ অবাক হয়ে তাকাই। দেখি রসকলিদের বেঞ্চের উল্টোদিকের বেঞ্চে চারজন বসেছে, অর্থাৎ একজনের সিট খালি। টেম্পো ছেড়ে দেবার আগে ড্রাইভার তার শেষ ঝাঁকুনি দিয়ে দেখতে চায়- যাবেন কোথায় আপনি?
আমি কোথায় যাব! নিজের মধ্যেই ভাবনা হয়- কোথায় যাব আমি! কোথায়? এই গানের নেশায় একদা আমিও ছেঁউড়িয়ামুখী হতেই চেয়েছিলাম। বাস্তবের ধুলোমাটিতে হোঁচট খেয়ে সেই গন্তব্য হারিয়ে ফেলেছি কবে, আজ আর মনেই পড়ে না। এখন প্রতিদিন আমি কুষ্টিয়া যাই, এই পথেই রোজ যাওয়া-আসা। কুষ্টিয়া শহরে সরকারি চাকরি। হোক সামান্য কেরানিগিরি, তবু ওই চাকরির সুবাদেই স্ত্রী-পুত্র নিয়ে মাটির উপরে সোজা হয়ে দাঁড়ানো। কুষ্টিয়ায় যাব বলেই তো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। তাহলে আর দ্বিধা কেন! টেম্পো ড্রাইভারকে জবাব দিলেই তো হয়- কুষ্টিয়া যাব। না, সেটা বলা হয় না, বাগযন্ত্রে বাধ সাধে। বরং বুকের মধ্যে কে এক অচেনা বাউল বাবরি চুল ঝাঁকিয়ে হা হা করে হাসে আর বলে- নিজের সঙ্গেও প্রতারণা? তুমি কি ছেঁউড়িয়া যেতে চাওনি? এই রসকলি যখন গাইছিল ‘আমি একদিনও না দেখিলাম তারে…’ তখন তোমার দু’চোখ জুড়ে কোন তৃষ্ণা ছিল বলো! তুমিও তো অলক্ষে গলা মিলিয়েছিলে, ‘পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম, যাতনা সকল যেতো দূরে…’ তুমি কেন গাইছিলে মনে মনে? কী ছিল তোমার মনে?
টেম্পো ড্রাইভারের আর দোষ কী! আমার মতো একটা প্যাসেঞ্জার না হলেও তার চলে। আমার জবাব শোনার জন্য আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে! চাকা গড়ালে হয়তো সামনেই পেয়ে যাবে প্যাসেঞ্জার। বিকট শব্দে গর্জন করতে করতে টেম্পো স্টার্ট করে সে। অতপর কালো ধোঁয়ায় আমার চোখমুখ ঢেকে দিয়ে দিব্যি চলে যায়।
নিস্তব্ধ চরাচরে কেবল আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি গন্তব্যবিভ্রান্তি নিয়ে। সূএ:রাইজিংবিডি.কম